ইসলামে পশু-পাখির অধিকার

শেখ ফরিদ আলম- শিরোনামটা অনেককে অবাক করবে। অনেকের ঠোঁট প্রসারিত হয়ে মুখে একটা মুচকি হাসি খেলে যাবে। হুহ! যে ধর্মে কোরবানি নামের পশুবলি উৎসব আছে, সে ধর্মে আবার পশু অধিকার! আমাদের সমাজে এমন লোকের মোটেও অভাব নেই। কোরবানির কারণে অনেকেই মনে করেন ইসলাম একটা হিংস্র ধর্ম। অথচ সত্যটা একেবারেই উল্টো। ইসলাম পশু-পাখিদের যে অধিকার ১৪০০ বছর আগে দিয়েছে সেগুলোর জন্য মাত্র কিছু বছর থেকে সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থাগুলো ব্যবস্থা নিচ্ছে। ইসলামে জীব-জন্তুদের অধিকার জানার আগে আমাদের একটা কথা জেনে নেওয়া উচিত। আল্লাহ পশু-পাখি এবং পৃথিবীর সবকিছু অর্থাৎ গাছ, জল, আকাশ, সুর্য শুধু মানুষদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন’ (সুরা বাক্বারাহ : ২৯)। ইসলাম বৈধ পশু পাখি খাওয়া জায়েজ। ইসলাম এমন অযৌক্তিক কথা বলে না যে সবাই নিরামিষাসী হও অথবা প্রাণ খেও না। এটা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক ও যুক্তিহীন কথা। সবাই নিরামিষাশী হলে পৃথিবী টিকেই থাকত না। আর উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে, তাহলে মানুষ খাবে কী?

ইসলাম পশু পাখি খাওয়ার অনুমতিও দিয়েছে আবার সেসঙ্গে কিছু সাবধান বাণীও দিয়েছে। ইসলাম পশুপক্ষীর ন্যায্য অধিকার দিয়েছে। অকারণে তাদের মেরা ফেলা, খাওয়ার জন্য ছাড়া হত্যা করা, তাদের ওপর বেশি বোঝা চাপানো, নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য তাদের কষ্ট দেওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর অভিশাপ সেই ব্যক্তির ওপর, যে (অকারণে) পশুর অঙ্গহানী ঘটায় (নাসাঈ : ৪৪৪২; ইবনে হিব্বান, বাইহাকী)। অর্থাৎ শুধু মজা করার জন্য কোনো পশুর অঙ্গহানী করা যাবে না। তাকে কোনোভাবেই অকারণ কষ্ট দেওয়া যাবে না।

আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) একবার কুরাইশ বংশের কতিপয় নবযুবকের কাছে দিয়ে অতিক্রম করার সময় লক্ষ্য করলেন যে, তারা একটি পাখীকে বেঁধে রেখে (হাতের নিশানা ঠিক করার মানসে তার ওপর নির্দয়ভাবে) তীর মারছে। তারা পাখির মালিকের সঙ্গে এ চুক্তি করেছিল যে, প্রতিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট তীর তার হয়ে যাবে। সুতরাং যখন তারা ইবনে উমারকে দেখতে পেল, তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল। ইবনে উমার (রা.) বললেন, ‘এ কাজ কে করেছে? যে এ কাজ করেছে তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ। নিঃসন্দেহে রাসুলুল্লাহ (সা.) সেই ব্যক্তির উপর অভিশাপ করেছেন, যে কোনো এমন জিনিসকে (তার তীর খেলার) লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে, যার মধ্যে প্রাণ আছে’ (বোখারি, মুসলিম)।

প্রশ্ন হলো, অকারণ বা মজা করার জন্য পশুহত্যা করা কেমন ধরনের পাপ? মহানবী (সা.) এব্যাপারে বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সব চাইতে বড় পাপিষ্ট ব্যক্তির একজন হলো সেই ব্যক্তি, যে খামাখা পশুহত্যা করে’ (হাকেম, বাইহাকি, সহিহুল জামে’ :১৫৬৭)। খামাখা পশু হত্যাকারী অর্থাৎ শখের শিখারী যারা তারা হলো সব চাইতে বড় পাপিষ্টদের একজন। পশু শিকার অনেকের কাছে অনেক গৌরবের হলেও ইসলাম তার অনুমোদন করে না। অর্থাৎ ইসলাম পশুদের বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে। তাদের অকারণ হত্যা করাকে নিষিদ্ধ করেছে। এব্যাপারে দয়ার নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অধিকার ছাড়া (অযথা) একটি বা তার বেশি চড়ুই হত্যা করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ সেই চডুই সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন’। বলা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! অধিকারটা কী (যে অধিকারে তাকে হত্যা করা বৈধ হবে)?’ তিনি বললেন, ‘অধিকার হলো এ যে, তা জবাই করে খাওয়া হবে এবং মাথা কেটে (হত্যা করে) ফেলে দেওয়া হবে না’ (নাসাঈ; সহিহ তারগিব : ২২৬৬)।

এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, শুধু খাওয়ার উদ্দেশ্যেই হত্যা করা যাবে। অন্য কোনো কারণে নয়। তবে, কোনো জন্তু জানোয়ার মানুষের ক্ষতি করলে তাকে মেরে ফেলা যাবে। বিষাক্ত প্রাণী ঘরে ঢুকলেও তাকে মেরে ফেলা যাবে। যেমন সাপ বা বিচ্ছু। তবে বাইরে কোথাও যেখানে তারা মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না, সেখানে তাদের মারা যাবে না এবং একজনের কারণে পুরো দলকেও মারা যাবে না।

একদা একটি গাছের নিচে একজন নবীকে পিঁপড়ে কামড়ে দিলে তিনি গর্তসহ পিঁপড়ের দল পুড়িয়ে ফেললেন। আল্লাহ তাকে অহি করে বললেন, ‘তোমাকে একটি পিঁপড়ে কামড়ে দিলে তুমি এমন একটি জাতিকে পুড়িয়ে মারলে, যে (আমার) তসবিহ পাঠ করত? তুমি মারলে তো একটিই মারলে না কেন, (যে তোমাকে কামড়ে দিয়েছিল)?’ (বোখারি, মুসলিম : ২২৪১)। ভেবে দেখুন ইসলাম শুধু পশু পাখি নয়. একটা সামান্য পিপড়ার অধিকারও নিশ্চিত করেছে। সুবহান’আল্লাহ!

এছাড়াও বলা হয়েছে, একটা পশুর সামনে অন্য পশুকে জবাহ না করতে, মা পাখির থেকে তার শিশুকে আলাদা না করতে, পশু পাখিকে খাবার না দিয়ে বেঁধে না রাখতে ইত্যাদি। এমনকি, পশু পাখির প্রতি দয়াপ্রদর্শনে আছে নেকি। একদা লোকরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! জীব-জন্তুর প্রতি দয়াপ্রদর্শনেও কি আমাদের সওয়াব আছে? তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক সজীব প্রাণবিশিষ্ট জীবের (প্রতি দয়াপ্রদর্শনে) সওয়াব বিদ্যমান’ (বোখারি : ২৪৬৬; মুসলিম : ২২৪৪)।

আলোকিতবাংলাদেশ।।